শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪

থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্যের দূষণচক্রে নগরীর পরিবেশ

আয়তেন বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৪তম হলেও জনসংখায় অষ্টম, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায়ই ১৭ কোটি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ ভাগ লোক শহরে বাস করে। শহরে বাস করার তথা নগরায়ণের প্রবণতা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে যে ২০২৫ সালের মধ্যে এ দেশে নগরায়ণের মাত্রা ৫০ শতাংশে পৌঁছবে । ২০৫০ সালের মধ্যে শহরে বসবাসরত জনগণের সংখ্যা ৫৬ শতাংশে উন্নীত হবে (ইউএন, ২০১৪)। মানুষ নগরমুখী। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সুচিন্তিত পদক্ষেপহীনতার কারণে নগরবাসী যথাযথ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, এবং নগর সেবাদান কেন্দ্রগুলা অতিরিক্ত মানুষের চাপে সেবার মান নিম্নমুখী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শহরে বর্জ্য তৈরির হার বেড়েই চলছে। ধারনা করা হয় বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। রাজধানী ঢাকায় সমস্ত দেশের এক-চতুর্থাংশ বর্জ্য উৎপাদন হয়। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অবস্থান দ্বিতীয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মতে, প্রতিদিন এই শহরে ২২০-২৫০ টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নগরের একটি বড় সমস্যা। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে অশোধিত অবস্থায় পরিবেশে যুক্ত হচ্ছে বর্জ্য, যার ফলে নগরের পরিবেশ ও নগরবাসীর স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে। বর্জ্য আবাসিক, বাণিজ্যিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিল্প উৎস থেকে আসছে। সময়ের সঙ্গে শহরে বর্জ্যের ধরন বদলে যাচ্ছে। 

চট্টগ্রাম নগরীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আরেক হুমকি হল থার্মোকল, স্টাইরোফোম বা ককসিট বর্জ্য। এই দুটি পলিস্টাইরিন পণ্য প্লাস্টিকের মতই যা, পেট্রোলিয়াম থেকে উৎপন্ন। থার্মোকল হালকা ওজনের, যা দামী ও ভঙ্গুর জাতীয় পণ্য/দ্রব্য প্যাকেজিং এবং দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য পণ্য সংরক্ষণে ও পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। ককসিট তাপ নিরোধক (ইনসুলেটিং বৈশিষ্ট্যের জন্য) বলে, বিভিন্ন কাচাঁমাল- মাছ, শাক-সবজি, ফল-মুল ইত্যাদি পণ্য সংরক্ষণে ও পরিবহনে  বহুল ব্যবহৃত হয়। থার্মোকলের বহুমুখী ব্যবহারিতা রয়েছে, বর্তমানে বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের সাজ সজ্জায় এটি বহুল ব্যবহ্রত হচ্ছে। তাছাড়া মৌসুম পরিবর্তনের সাথে সাথে ও এই থার্মোকলের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে থাকে, যেমন গ্রীষ্মকালে  থার্মোকলের ব্যবহার শীতকালের ছেয়ে তুলনামূলক বেশি হয়ে থাকে। কারণ, থার্মোকলের ইনসুলেটিং বৈশিষ্ট্যের জন্য গ্রীষ্মকালের আনেক ফলমূল, মাছ, শাক-সবজি সংরক্ষণ ও পরিবহনের উদ্দেশ্যে এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। তাছাড়াও বিভিন্ন দামী ও ফেন্সি উপকরণ যেমন, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এসি, কাচেঁর তৈরি বিভিন্ন পণ্য  প্যাকেজিং ও পরিবহনে থার্মোকল বা ককসিট এর ব্যবহার হয়। থার্মোকল একটি অপঁচনশীল বর্জ্য, এটি সহজে মাটিতে মিশে না। এটি নিস্পত্তি হতে বা পঁচে যেত প্লাস্টিক বর্জ্যের ন্যায় শত শত বছর সময় লাগে, যা মাটি ও পানির জৈব গুণ নষ্ট করছে। অতি ক্ষুদ্র ককসিট কণাকে মাছ ও পাখি খাবার মনে করে খেয়ে ফেলছে, এভাবে তা মানুষের খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়ছে ককসিট। এসব ককসিট খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে তা ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগবালাই তৈরি করছে।  

গবেষণায় জানা যায়, থার্মোকল বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য। যেহেতু, চট্টগ্রামে এখনো ককসিট বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের ভেল্যু চেইনটি গড়ে ওঠেনি। যার ফলে, এই বর্জ্যটি যেখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যার শেষ পরিণতি হয় ড্রেন, খাল, নালা বা জলাধার। যেহেতু এটি হালকা, তাই সেটি পানির উপর ভেসে থাকে ও নগরের ড্রেনেজ সিষ্টেমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। যার ফলে সামান্য বৃষ্টিতে দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা ও বিভিন্ন ভেক্টর বাহিত রোগ। গ্রীষ্মকাল আসন্ন, কিছুদিনের মধ্যে শুরু হবে মৌসুমের বৃষ্টিপাত। তাই, শহরকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা করতে ও ভেক্টর বাহিত রোগের ঝুঁতি থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে এখনি নিতে হবে কার্যক্রর পদক্ষেপ। ধারনা করা হয়, ককসিটে জমা পনিতে এডিস মশা ডিম পাড়তে পারে যা, শহরের ডেঙ্গু  সংক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।  ২০২৩ সালে, বাংলাদেশে ডেঙ্গু  সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল। গত ২৩ বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মোট মারা গেছেন ৮৬৮ জন। কিন্তু ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় ১৮০০ জন। ঢাকার পর ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে। তাই, নগরের পরিবেশ সংরক্ষণ ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এই থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্যকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ককসিট বর্জ্যকে ল্যান্ডফিলে নিস্পত্তি না করে রিসিাইকেল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এনে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে হবে।

থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্যকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো বিবেচনায় আনা যেতে পারে;

  • ককসিট বর্জ্যকে উৎসে পৃথকিকরণ করতে হবে;
  • ককসিট বর্জ্য উৎসে পৃথকিকরণ ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য নগরবাসিকে সংবেদনশীল করতে হবে;
  • কঠিন বর্জ্য সংগ্রহকারী বা সেবকদের ককসিট বর্জ্য সংগ্রহের ব্যাপরে আগ্রহ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে;
  • নগরের নির্দিষ্ট ভাংগারীওয়ালাদেরকে চিহ্নিত করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ককসিট বর্জ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কৌশল সম্পর্কে অবগত করতে হবে;
  • প্রয়োজনে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে বেশি কিছু ভাংগারীওয়ালা তৈরী করতে হবে, যারা ককসিট বর্জ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের আগ্রহী;
  • চট্টগ্রামের রিসাইক্লিং ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে, অবগত করা যে, ককসিট বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং এই পুনর্ব্যবহারের কৌশল ও কারিগরি সহায়তা প্রদান;
  • ককসিট বর্জ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে কথা বলা  ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১ অনুযায়ি উৎপাদনকারির সম্প্রসারিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি;
  • কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ ককসিট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় পর্যায়ে জনগণকে অংশগ্রহণ করা ও এর সঠিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণা;
  • সরকার, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহ ককসিট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একসাথে কাজ করা।
ককসিট বর্জ্য বিষয়ে গবেষণার অভাবে সঠিকভাবে বলা খুব কষ্টকর যে, কি পরিমাণ ককসিট বর্জ্য প্রতিদিন এই শহরে উৎপন্ন হচ্ছে, তবে বর্জ্য সংগ্রহকারী ও ভাংগারীওয়ালাদের সাথে কথা বলে  ধারনা করা যায়, চট্টগ্রাম শহরে উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের প্রায়ই ৪-৫ শতাংশ হবে থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্য। পরিমাণে এই অংশ কম হলেও আশংকা বা ঝুঁকি কিন্ত অনেক। বর্ষা মৌসুমে নগরের রাস্তা ও ড্রেন দুটোই পানিতে তলিয়ে যায়, ভেসে থাকে এই ককসিটগুলো আর তাই পথচারীরা বুঝতে পারে না কোথায় রাস্তা এবং কোথায় ড্রেন। যার ফলে ঘটছে, ড্রেনে পড়ে মুত্যুর সংখ্যা। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১৭ সাল থেকে গত ৭ বছরে নগরীর অরক্ষিত ড্রেন ও খালে পড়ে কমপক্ষে ৮ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়েছে। তাই, বর্ষা মৌসুমের আগে নগরির খোলা অরক্ষিত ড্রেনগুলা দ্রুত চিহ্নিত করে সংস্কার করতে হবে এবং জলাবদ্ধতার জন্য অন্যতম দায়ী থার্মোকল বা ককসিট বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

Photo Source: https://dainikishan.com


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন